দীপক স্যার অন্য দশজন শিক্ষকের মত নন, শিক্ষক বলতে যা বোঝায় আসলেই তিনি তা । ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর কাছে কী তা জানিনা, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি বেষ্ট ফ্রেন্ড । নূতন বছরের প্রথম ক্লাস, ৩রা বৈশাখ । খোঁজ খবর নিচ্ছেন সবার । রমেন এসেছে হেয়ার স্টাইল বদলে, সবাই আজ ওকে নিয়ে হাসতে চলেছে  তা বুঝতে পারছিল । কিন্তু শুরুটা যে স্যার নিজে করবেন তা হয়তো ভাবেনি ।

-       কিতাবা রমেন, তুমি দেকি চুল উল কাটিয়া এ কি অবস্থা !?

-       না স্যার, মায় গাইল্লাইয়া কাটাইসইন... কইন পড়াশুনা করিনা আর খালি স্টাইল, তে কই দেও কাটিয়া, আর হেও দিসে ।

-       বাড়িত কাটসঅ না কিতা ?

-       না স্যার, মায় টানিয়া লইয়া গেসইন সেলুনঅ । সেলুনর হে ঔ দিসে কাটিয়া    হে আবার কয়, তুমার মা বেজান গরম না কিতা ? আমি কই অয়রেবা ।

-       মায় মারইন নি?

-       না স্যার, আগে মারতা। ছুট থাকতে, অখন মারইন না ।

-       আর বাবায় কিতা কইলা ?

-       বাবায়... বাবায় আর কিতা কইতা, কিচ্ছু কইসইন না !

উফ, বাবার কথা কেন ? বাবার কথা উঠলেই সারা শরীরে কেমন এক ভয় প্রবাহিত হয় । ইচ্ছে করে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে । চোখে জল আসে, চোখে জল আসেওনা । এই যন্ত্রণাটুকু শব্দে প্রকাশ করা যায়না, আর গেলেও সে শব্দকে অনুভব করতে পারবেনা সবাই, পাশে যতগুলো মেয়ে, যতগুলো ছেলে, কেউ বুঝবেনা । বাবা নেই, অথচ বাবা মৃত নন । নিখোজ, এই সামান্য শব্দটুকু উচ্চারণ করতে গিয়ে কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, তাই এই প্রয়াস আর এখন সে করেনা । কাউকে বলেনা আর । বাবা আছেন, বাবা নেই ! ওর নিজের জন্যেও এটা এক রহস্য হয়ে উঠেছে ।

আরও অনেক কথা হচ্ছে, স্যার কত কিছু বলছেন । পয়লা বৈশাখের গল্প । অথচ কোন কথাই আর কোন সেন্স সৃষ্টি করতে সক্ষম হলনা রমেনের মনে । হঠাৎ আবারো একটা প্রশ্ন আঘাত করলো,

-       রমেন তুমার বাবায় কিতা করইন ?

-       হিঁ, বাবায়, বাবায় করইন...

বাবা অনেক কিছুই করেন, কোলে নেন, আদর করেন, সাইকেল চালাতে লাইসেন্স লাগে, এমনটা বলেন । আবার কিনেও দেন । বাবা, বাবাতো অনেক কিছুই করেন... অথচ কিছুই আর বলতে পারছেনা... সুজিৎ বলল,

-       তার বাবা নিখোঁজ স্যার ।

-       অ্যাঁয়?

-       নিখোঁজ স্যার তার বাবা ।


স্যারের এতগুলো প্রশ্নের চেয়ে সুজিতের উত্তরটা সহ্য করা ছিল অনেক বেশি কষ্টের । অথচ সুজিৎ খারাপ কিছু চায়নি, করেও নি, ভালোই হয়েছে । ভালোর জন্যেই করেছে । ভালোই হয়েছে । আর বাবার প্রসঙ্গ স্যার তুলবেননা । সুজিৎকে যদি সবসময় সঙ্গে রাখা যেত, কি ভালো হত । যখনই কেউ বাবা কে? বাবা কী করেন জানতে চাইতো, নিষ্ঠুরের মত সুজিৎ তখন বলে দিতে পারতো, ‘তার বাবা নিখোঁজ । নিখোঁজ তার বাবা ।‘ কি মিষ্টি করে বলে ফেলে এত কঠিন সত্য, আজব মুন্সিয়ানা ওর কণ্ঠে । কারণ হতে পারে ওর কাছে কঠিন সত্যটা কঠিন নয়, হয়তো নিজের নয় বলেই ।



পড়ায় মন বসছেনা । কষ্ট হচ্ছে । বাবার কথা মনে পড়ছে, এমন নয় । নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আসলে । বছর সাতেক হল বাবা নিখোঁজ, অথচ একটা F.I.R অব্দি করা হয়নি আজো । সবাই বলল, ফিরে আসবেন কদিন পর । সেই কয়েকটা দিন ফুরোলনা ! কখনোই কি ফুরোবেনা ? সেদিন রিকি বলছিল ওর বাবাও নেই, মারা গেছেন । তাই ও নাকি রমেনের কষ্ট বোঝে । সত্যি কি বোঝে ? মৃত্যুতো তাও ভালো, শ্রেয় । কিন্তু বেঁচে আছেন কি না, এটা না জানা যে কত কষ্টের তা কি বোঝা সম্ভব ? জানা নেই ! পড়ায় মন নেই, মন নেই কিছুতেই । ভালো না লাগার দুরন্ত উল্লাস যেন চারদিকে । রাত বাড়ে, বেড়েই চলেছে । মেসেজ আসছে, উত্তর দিচ্ছে একে একে । কিন্তু নিঃসঙ্গতার উল্লাস থেকে মুক্তি কিছুতেই মিলছেনা ।